দোয়েল (Magpie-robin)
বাংলাদেশের জাতীয় পাখি দোয়েল (Magpie-robin)। বাংলা দোয়েল নামটির সাথে রাসী ও ওলন্দাজ নামের মিল আছে। ফরাসী ভাষায় একে বলা হয় Shama dayal এবং ওলন্দাজ ভাষায় একে বলা হয় Dayallijster। দোয়েল Passeriformes (চড়াই-প্রতিম) বর্গের অন্তর্গত Muscicapidae গোত্রের সদস্য। এর বৈজ্ঞানিক নাম Copsychus saularis।
শারীরিক বৈশিষ্ট্য
দোয়েল আকারে ১৫-২০ সেন্টিমিটার বা ৭ – ৮ ইঞ্চি লম্বা। এর লম্বা লেজ আছে যা অধিকাংশ সময় খাড়া করে রাখে। পুরুষ দোয়েলের শরীরের উপরিভাগ ও গলার নিচে কালো রঙের, পেট সাদা। ডানার দুই পাশে সাদা রঙের প্যাচ আছে। স্ত্রী দোয়েলের উপরিভাগ ও গলার নিচে ছাই-রঙা হয়। পেটের অংশ পুরুষ দোয়েলের মত উজ্জ্বল নয়, বরং কিছুটা ফিকে সাদা। কিন্তু দেখতে অপরূপ।
স্বভাব-প্রকৃতি
দোয়েল খুবই চঞ্চল ও স্বাধীনচেতা। নানা রকম সুরে ডাকাডাকির জন্য দোয়েল সুপরিচিত। যেকোনো ঋতুতেই সে গান গায়। তবে তার বাসা বাঁধার গান শুরু হয় শীত মৌসুমে। গান গেয়ে আশপাশের সব পাখিকে বাসা বাঁধার খবর জানায়। এ পাখির বাসা তৈরির প্রধান উপকরণ যে কোনো গাছের অত্যন্ত সরু ডাল, মানুষের চুল, গবাদি পশুর পশম ও লোম, শুকনো দূর্বাঘাস, খড়, উলুঘাস, গাছের শিকড়, ধানের শুকনো কুটো ইত্যাদি। প্রয়োজন না হলে দোয়েল এক নাগাড়ে বেশি দূর ওড়ে না। মাটিতে লাফিয়ে লাফিয়ে খাদ্য খোঁজে। অস্থির এই পাখীরা সর্বদা গাছের ডালে বা মাটিতে লাফিয়ে বেড়ায় খাবারের খোঁজে। দোয়েলের খাবার তালিকায় আছে বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, কেঁচো, খেজুরের রস, ধান বা ভাত। তবে কীট পতঙ্গ, ছোট ছোট শুঁও পোকা এদের প্রধান খাদ্য। কখনো কখনো সন্ধ্যার আগে আগে এরা খাবারের খোঁজে বের হয়। ধান, পাট, শাক-সবজি এসবের জন্য ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে সাবাড় করে বলে দোয়েল সমাজের উপকারী পাখি হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।
প্রাপ্তিস্থান
নাতিশীতোষ্ণ দক্ষিণ এশিয়ায় মূলত: বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, চীনের দক্ষিণাঞ্চল ও ফিলিপাইনে এদের পাওয়া যায়। সাধারণত কাঠসমৃদ্ধ বন, চাষাবাদকৃত জমির আশেপাশে ও জনবসতিতে মানুষের কাছাকাছি এদের দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলে এবং বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় সব শহরাঞ্চলেই দোয়েল দেখা যায়।
বংশবিস্তার
দক্ষিণ এশিয়ায় দোয়েলের প্রজননকাল মার্চ থেকে জুলাই; আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জানুয়ারি থেকে জুলাই। প্রজনন সময় পুরুষ দোয়েলের শরীরের রঙ উজ্জ্বলতর হয়। প্রজনন ঋতুতে স্ত্রী দোয়েলকে আকৃষ্ট করার জন্য পুরুষ দোয়েল খুব ভোরে এবং পড়ন্ত দুপুরে সুরেলা গলায় অত্যন্ত জোরে গান গায়। ডিম দেয়ার এক সপ্তাহ আগে এরা গাছের কোটরে বা ছাদের কার্ণিশে বাসা বানায়। সাধারণত ৪/৫টি ডিম দেয়। ডিমের রং ফিকে নীলচে-সবুজ, তার উপর বাদামী ছোপ থাকে। স্ত্রী দোয়েল ডিমে তা দেয়; ৮ থেকে ১৪ দিন পরে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। প্রজননকালে পুরুষ দোয়েল আগ্রাসী হয়ে ওঠে। তখন বাসার আশেপাশে অন্য পাখিদের আসতে দেয় না। দোয়েল ১৫ বছর পর্যন্ত বাঁচে।
সাংস্কৃতিক তাৎপর্য
বাংলাদেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে দেশীয় ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে দোয়েল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকদের লেখাতে এই পাখির উল্লেখ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মুদ্রাতে (টাকা) এই পাখির ছবি বহুল ব্যবহৃত। এই পাখির নামে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে দোয়েল চত্বর নামে একটি সড়ক চত্বর আছে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকার মাঝে অবস্থিত।