যাদব পায়েং একাই বানালেন জঙ্গল, যেখানে থাকে বাঘ, হাতি ও গণ্ডার
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। আয়তনে প্রায় ১২০০ একর। বাংলাদেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের কারণেও।
এবার একটু বিপদে ফেলে দেই। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা এনেছি একটা তুলনা করার জন্য। কেমন হবে যদি বলা হয়, এমন ১২০০ একর জায়গাকে একটি প্রাকৃতিক অরণ্যের রূপ দিতে হবে। যেখানে বাস করবে হরিণ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, গন্ডার, হাতিসহ কয়েকশ প্রজাতির প্রাণী। একটু অবাক হবেন আপনিও। এও কি সম্ভব। বনায়ন করে হয়ত ছেয়ে ফেলা যাবে জায়গাটিকে, বড়জোর সেখানে আবাস হবে হরেক প্রজাতির পাখি, সাপ, বানর কিংবা বড়জোর দুই এক প্রজাতির মাংসাশী প্রাণী। কিন্তু বাঘ, হাতি, গন্ডার!

একটু পেছনে চলে যাই। প্রায় চার দশক আগে। দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া এক বালকের কথা যে কিনা পরীক্ষা শেষ করে ফিরছিল তার আবাসস্থলে। পড়াশুনার জন্য বিগত ১০টি বছর তাকে থাকতে হয়েছিলো অনেক দূরে। যাওয়ার আগে সে যে জায়গায় শৈশব কাটিয়েছে তা ছিল সবুজে ঢাকা একটা জনপদ। কিন্তু ফেরার সময় বালকটি বিশ্বাস করতে পারছিল না নিজের চেনা জায়গাকে। এই জনপদে আর সবুজের লেশ নেই। আছে বালিময় এক সদ্য জন্ম নেওয়া মরুভূমি। জনপদের নাম অরুণা সাপোরি। ব্রহ্মপুত্রের বুকে ছোট্ট একটা দ্বীপ। সেই সময়ের ঐ ১৬ বছরের বালকের নাম যাদব পায়েং।
যাদব পায়েংদের গ্রাম ছিল এই অরুণা সাপোরিতে। কিন্তু মানুষের লোভ দ্বীপের বনজঙ্গল একেবারে সাফ করে দিয়েছে। প্রকৃতিও নিয়েছে তার প্রতিশোধ। নদীভাঙ্গনে হারিয়ে যায় তাদের গ্রাম। যাদব পায়েংদের তখন আশ্রয় হয় নদীর অন্য তীরে। প্রায় ১২ কি.মি. দূরে মাজুলিতে। কিন্তু একটা সবুজ দ্বীপ মরুভূমি হয়ে যাওয়া সেদিন মেনে নিতে পারেনি সেইদিনের কিশোর যাদব পায়েং।
গ্রাম ছেড়ে এলেও অরুণা সাপোরির সাথে সম্পর্ক থেকেই যায় যাদব পায়েংদের পরিবারের। সেই গ্রামে ছিল যাদব পায়েংদের পশুখামার। ছিল পারিবারিক দুধের ব্যবসা। দ্বীপে যাওয়া আসার স্বার্থে যাদব পায়েংয়ের আকুলতা বাড়তে থাকে আবারও একটা সবুজ দ্বীপ ফিরে পাওয়ার। এরই মধ্যে মারা যায় যাদবের বাবা-মা। ১৩ ভাইবোনের সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে যাদবের কাঁধে।

সেই আকুলতা থেকে গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলতে শুরু করে যাদব। কিন্তু কে তাকে পাত্তা দেবে? সবাই বরং তাকে পারিবারিক ব্যবসা ঠিকঠাক দেখাশোনার পরামর্শ দিচ্ছিলেন।
একদিন এক বৃদ্ধ এলো যাদবের পথপ্রদর্শক হয়ে। গ্রাম থেকে দূরে ডেকে নিয়ে যাদবের হাতে তুলে নিলেন ৫০টি বীজ ও ২৫টি বাঁশ গাছের চারা। বলেছিলেন, “গাছ লাগাও বাবা, শুধু সাপরা কেন আমরা সবাই বাঁচব। একটা কথা মাথায় রেখো, যেখানে গাছ, সেখানেই পাখি। যেখানে পাখি, সেখানে ডিম। যেখানে ডিম, সেখানে সাপ। আবার যেখানে গাছ, সেখানে চারা। যেখানে চারা, সেখানে জঙ্গল। যেখানে জঙ্গল, সেখানে বৃষ্টি। যেখানে বৃষ্টি, সেখানে চাষাবাদ ও তোমাদের গরু-মোষের ঘাস।”

বৃদ্ধটি জানিয়েছিল, গাছ লাগানোর আদর্শ সময়। আর যাদব পেয়াং সেই কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে কাজ শুরু করল তার খামারের প্বার্শবর্তী জায়গা থেকেই। শুরু হলো একটা মরুভূমিকে অরণ্যে রূপান্তরের চেষ্টা। বছর খানেক বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে যাদব পায়েং সংগ্রহ করেছিলেন প্রায় হাজার প্রজাতির বীজ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিল দ্বীপের আনাচে কানাচে। এখন শুধু একটা বর্ষার অপেক্ষা। যাদব পায়েং হতাশ হননি। বর্ষা এসেছে দ্রুত। আগের কয়েকবছরের তুলনায় কয়েকগুণ বর্ষা হলো। আর দ্বীপ জুড়ে মাথা তুললো যাদবের বোনা বীজ। শিকড়ে আটকে থাকলো ক্ষয়ে যেতে থাকা মাটি।

সেই থেকে দ্বীপের আনাচে কানাচে গাছ লাগিয়ে যাচ্ছেন যাদব পায়েং। পরিচর্চা করছেন। এভাবে চলে গেলো প্রায় চার দশক। আর যাদব পায়েং পৃথিবীকে উপহার দিলেন ১৩৬০ একরের একটা অরণ্য। যা দেখে ভাবার কোনো উপায় নেই যে সেটি মানুষের হাতে তৈরী। কেননা, প্রকৃতি প্রেমী যাদব যে সেখানে রূপ দিয়েছেন প্রাকৃতিক ভাবেই।
কোন গাছটি লাগাননি তিনি। বাঁশ, বহেরা, সেগুন, গাম্ভরি, কাস্টার্ড আপেল, তারা ফল, গুলমোহর, ডেভিল’স ট্রি, তেঁতুল, তুঁত, কাঁঠাল, কুল, জাম, কলা গাছ, এলিফ্যান্ট গ্রাস সবই আছে। আছে অবাক করা আরও কিছু ব্যাপার। বনে থাকতে শুরু করেছে বিভিন্ন বন্যপ্রাণী। বর্তমানে বনে বাস করছে পাঁচটি রয়েল বেঙ্গল টাওগার, চারটি এক শিংওয়ালা গন্ডার, বুনো শুয়োর, শকুনসহ কয়েকশ প্রজাতির পাখি, কয়েক হাজার সাপ। শুধু তাই নয়, বছরের একটা সময় সেখানে বাস করে শ’খানেক হাতির পালও।

নিরলস প্রচেষ্টা তাকে নিয়ে এসেছে স্বপ্নের দ্বারপ্রান্তে। পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা। স্থানীয় লোকজন তাকে ডাকে ‘মোলাই’ নামে। ‘মোলাই’ নামের অর্থ জঙ্গল। আর সারা বিশ্ব তাকে চেনে ‘দ্য ফরেস্ট ম্যান’ নামে।
কাঠখড়ও কম পোহাতে হয়নি যাদব পায়েংকে। অরণ্যের পাশেই তার খামার। যেখানে পালন করা হয় গরু, মোষ ও শুয়োর। গত ৪০ বছরে যাদব পায়েংয়ের খামার থেকে বাঘে নিয়ে গিয়েছে ৮৫ গরু, ৯৫ মোষ আর ১০টি শুয়োর। তবুও ভ্রূক্ষেপ নেই যাদব পায়েংয়ের। যাদবের ভাষ্য, “বাঘেরা তো পশুপালন ব্যাপারটা বোঝে না। ওদের দোষ দিয়ে লাভ কী! মানুষ ওদের জঙ্গল কেড়েছে, তাই মানুষকেই তার দাম দিতে হবে।”
যাদব পায়েং। এই মহান মানুষের সাথে আমাদের পরিচয় হওয়ার পেছনে আছেন এক চিত্রগ্রাহকের ভূমিকা। স্থানীয় এই চিত্রগ্রাহকের নাম জিতু কলিকা। প্রাকৃতিক ধকলে নাজুক পথে চলতে চলতে তিনি সন্ধান পান এই অরণ্যের। জিতু সেখানে অপেক্ষা করছিলেন। হঠাৎ তিনি দেখা পান যাদবের। বনে চোরা শিকারিদের আনাগোনা বাড়ায় সন্দেহ হয় যাদব পায়েংয়ের। হামলা করে বসেন তিনি। তখন জিতু তার পরিচয় দিলে আশ্বস্ত হন যাদব পায়েং। কথায় কথায় শুরু হয় বন্ধুত্ব। স্থানীয় পত্রিকায় ছবিসহ ছাপলেন এই অরণ্যের কথা।
২০১২ সালে যাদবের এই অসামান্য ও একক অবদানের জন্য জওহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটি ‘আর্থ-ডে’র দিন তাকে ‘Forest Man of India’ শিরোপা দেয়। ওই বছরেই ভারতের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এপিজে আব্দুল কালাম মুম্বইয়ে যাদব পায়েংকে আর্থিকভাবে পুরস্কৃত করেন।

একই বছরে ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত ‘International Forum for Sustainable Development’-এর এক কনফারেন্সে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ৯০০ জন বিশেষজ্ঞের মধ্যে যাদব পায়েংও ছিলেন। ‘Wildlife Service Award’ দিয়েছে ‘Sanctuary Asia’ । ২০১৫ সালে যাদব পায়েং অর্জন করেছেন ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারও।

যাদব পায়েংয়ের এই বনে বেড়েছে চোরা শিকারিদের আনাগোনা। ২০১২ সালে চোরা শিকারিরা একটি গন্ডারের লেজ ও নখ কেটে নিয়ে গেলে বন বিভাগের সহায়তা চান যাদব। কিন্তু সেখানে তিনি অবজ্ঞার পাত্র হন। পরে গ্রামবাসীদের চাপে বন বিভাগ সেখানে পরিদর্শনে গেলে প্রমাণ মেলে সত্যতার।

যাদব পায়েং আফসোস করে বলেছিলেন, ‘জানেন, আমার ছোট ছেলে আর আমি কয়েক দিন খেতে পারিনি, যখন দেখেছিলাম চোরা শিকারিরা গন্ডারটির লেজ আর নখ কেটে নিয়ে গেছে। কিন্তু কী করব, একটি বিশাল অরণ্যকে সুরক্ষা দেওয়া আমার একার পক্ষে সম্ভব নয়।’

ফরেস্ট ম্যানের স্বপ্ন তার হাতে গড়া এই বন আরও বড় হোক। আরও প্রাণী আসুক। সেই লক্ষ্যে এখনও ছুটছেন তিনি। এখনও ফাঁকা জায়গা পেলেই লাগাচ্ছেন গাছ।