আড়িয়াল খাঁ নদ | Arial Khan River
দেশ – বাংলাদেশ
অঞ্চল – বরিশাল বিভাগ,
জেলাসমূহ – ফরিদপুর জেলা, মাদারীপুর জেলা, বরিশাল জেলা
উৎস – পদ্মা নদী
মোহনা – তেঁতুলিয়া নদী
দৈর্ঘ্য – ১৫৫ কিলোমিটার (৯৬ মাইল)
আড়িয়াল খাঁ পদ্মার একটি প্রধান শাখা নদ। আড়িয়াল খাঁ হচ্ছে ফরিদপুর, মাদারীপুর ও বরিশাল জেলার একটি নদ। নদটির দৈর্ঘ্য ১৫৫ কিলোমিটার (৯৬ মাইল), গড় প্রস্থ ৩০০ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। নদটির অববাহিকার আয়তন ১৪৩৮ বর্গ কিমি। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা “পাউবো” কর্তৃক আড়িয়াল খাঁ নদের প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী নং ২।
ইতিহাস
আড়িয়াল খাঁ’র ওপরের দিকে নাম ছিলো ভুবনেশ্বর। ১৮০১ সালে ঠগি দমন নিমিত্তে আড়িয়াল খাঁ নামক একজন জমাদার গভর্নমেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত হয়। ভূবনেশ্বর থেকে একটি খাল খনন করে তা প্রাচীন পদ্মার দক্ষিণাংশের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেয়া হয়। এই খালটিই কালক্রমে প্রবল রুপ ধারণ করে প্রচীন পদ্মা ও ভূবনেশ্বরের কিছু অংশ গ্রাস করে ফেলে এবং সাধারণ জনগণের কাছে আড়িয়াল খাঁ নামে পরিচিত হয়। এই দুটি নদীর অস্তিত্ব সতেরো- আঠের শতকের নকশাগুলোতে লক্ষ করা যায়। যদিও বর্তমানে প্রবাহ পথ অনেকটা গতি পরিবর্তন করেছে। মির্জা নাথনের বর্ণনায় এই নদীর নাম অণ্ডল খাঁ। নামটি দেখলে মনে হয় মধ্যযুগের মুসলমান শাসনামলে এই নদীর নাম দেয়া হয় অণ্ডল খাঁ, পরে পরিবর্তিত রুপে দাঁড়িয়েছে আড়িয়াল খাঁ।
নদের গতিপ্রকৃতি
পদ্মা নদীর গোয়ালন্দ ঘাট থেকে ৫১.৫ কিমি দক্ষিণ-পূর্বের পদ্মা থেকে এই শাখা প্রবাহিত হয়ে ফরিদপুরের সদরপুর, ভাঙ্গা, শিবচর ও মাদারীপুর সদর উপজেলার মধ্য দিয়ে বরিশারের গৌরনদী উপজেলার পূর্বভাগ দিয়ে তেতুঁলিয়া চ্যানেলে পড়েছে। নদটি সারা বছরই নাব্য থাকে। মাদারীপুর জেলা শহরের একদিকে আড়িয়াল খাঁ অন্য দিকে কুমার নদ থাকায় শহরটির দৃশ্য মনোরম। আর জোয়ার ভাটা দ্বারা নদ ও তীরবর্তী জনসাধারণের জীবনযাত্রাও প্রভাবিত হয়। মাদারীপুর পর্যন্ত স্বাভাবিক জোয়ার- ভাটার পরিসর ০.৩২ মিটার। কথিত আছে, শাহ মাদার নামের জনৈক ফকির এই স্থানে আড়িয়াল খাঁ নদের তীরে বাস করতো বলে তাঁর নামে স্থানের নাম হয় মাদারীপুর। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষেরা তাঁকে ভক্তিশ্রদ্ধা করেন। এই নদের ওপর ঢাকা-খুলনা সড়কে আড়িয়াল খাঁ সেতু ও ঢাকা-মাওয়া সড়কে শিবচর সেতু নির্মিত হয়েছে। নদীর বাম তীরে ২৪১ মিটার ও ডান তীরে ১৮৩৭.৫ মিটার ব্যাংক রিভেটমেন্ট আছে। নদীটির পানিপ্রবাহ বারোমাসি প্রকৃতির। মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রবাহ কম থাকে। আড়িয়াল খাঁর উৎস মুখে তখন ৪৭ ঘনমিটার/সেকেন্ড পানিপ্রবাহ থাকে। জুলাই-আগস্টে যখন প্রবাহ সবচেয়ে বেশি হয়, তখন প্রবাহের পরিমান দাঁড়ায় ৪০০০ ঘনমিটার/সেকেন্ড। এসময় নদীতে গভীরতা ১২ মিটার পর্যন্ত হয়। উনিশ শতকের শেষ দিকে আড়িয়াল খাঁ ছিল প্রধান ধারা। বর্তমানে এর শেষ প্রান্ত পলি ভরাট হয়ে মাদারিপুরের কাছে আড়িয়াল খাঁ দুটি শখায় বিভক্ত হয়েছে। বাঁ দিকের প্রবাহিত অংশ আড়িয়াল খাঁ। আর ডান দিকে টরকি নামে প্রবাহিত হচ্ছে।
আড়িয়াল খাঁ চলার পথে নাড়িয়ার খাল, পালং খাল, ভূবনেশ্বর, ময়নাকাটা, কুমার কাইলা, নয়াভাঙনী নদী প্রভৃতির মাধ্যমে পদ্মার সংঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে চলছে। নদীর গতিপথ প্রায়ই আঁকাবাঁকা, নদীটি ভাঙ্গনপ্রবণ। ফলে কত যে জনপদ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে তার হিসাব নেই। মাদরীপুর শহরও এই নদীর ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। এই নদী তীরবর্তী উল্লেখযোগ্য স্থানগুলো হলো পিয়াজখালী, চৌধুরীরহাট, উতরাইল, দত্তপাড়া, কবিরাজপুর, লতিখোলা, ছবিপুর, মাদারীপুর পৌরসভা, ঘাসেরহাট বন্দর।
অন্যান্য তথ্য
বর্তমানে সমুদ্রগামী পদ্মার শাখাগুলোর মধ্যে মধুমতী ও আড়িয়াল খাঁ প্রধান। ধলেশ্বরী-গঙ্গা যেমন পদ্মার উত্তরতম প্রবাহপথের স্মারক, তেমনি আড়িয়াল খাঁ। মার্চ-এপ্রিলে পানির প্রবাহ কম থকে। তবে বর্ষাকালে পানি প্রবাহ বেশি থাকে। তখন জুলাই-আগস্ট মাসে প্রবাহের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ হাজার ঘনমিটার/সেকেন্ড। এ সময় নদে পানির গভীরতা ১২ মিটার পর্যন্ত থাকে।
বিশিষ্ট কবি রত্নেশ্বর হাজরার ‘মিষ্টিকুটুম’ কবিতায় আমরা পাই আড়িয়াল খাঁ’র নাম-
মাদার ডালে মাদার ফুল সকালবেলা হাসবে
ইষ্টিকুম মিষ্টিকুটুম আমার বাড়ি আসবে!
ব্যস্ত হবে আমার দিদি, ব্যস্ত হবে মা-
আড়িয়াল খাঁ নদীর জলে কালন মাঝির না-’
তথ্যসূত্র
১. মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক, বাংলাদেশের নদনদী: বর্তমান গতিপ্রকৃতি, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৫, পৃষ্ঠা ১৭-১৮, আইএসবিএন 984-70120-0436-4
২. ড. অশোক বিশ্বাস, বাংলাদেশের নদীকোষ, বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ (দ্বিতীয় প্রকাশন), পৃষ্টা ১৪১-১৪২, ISBN-978-984-91643-5-7
৩. মোকাররম হোসেন, বাংলাদেশের নদী, কথাপ্রকাশ, আগস্ট ২০১৪ (দ্বিতীয় সংস্করণ), পৃষ্ঠা ১৩৮ ও ১৩৯