বুড়িগঙ্গা নদী | Buriganga River
বুড়িগঙ্গা নদী বাংলাদেশের উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি নদী। নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। নদীটির দৈর্ঘ্য ২৭ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৩০২ মিটার এবং গড় গভীরতা ১০ মিটার। বুড়িগঙ্গা ধলেশ্বরী নদীর একটি শাখা নদী। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা ‘পাউবো’ কর্তৃক বুড়িগঙ্গা নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নদী নং ৪৭।
বুড়িগঙ্গা নদীর সৃষ্টি হয়েছিল ব্রহ্মপুত্র আর শীতলক্ষ্যার পানি এক স্রোতে মিশে। কথিত আছে, গঙ্গা নদীর একটি ধারা প্রাচীনকালে ধলেশ্বরী হয়ে সোজা দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে মিশেছিল। পরে গঙ্গার সেই ধারাটির গতিপথ পরিবর্তন হলে গঙ্গার সাথে তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে প্রাচীন গঙ্গা এই পথে প্রবাহিত হতো বলেই এমন নামকরণ। মূলত ধলেশ্বরী থেকে বুড়িগঙ্গার উৎপত্তি। কলাতিয়া এর উৎপত্তিস্থল। বর্তমানে উৎসমুখটি ভরাট হওয়ায় পুরানো কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। ঢাকা শহরের জন্য বুড়িগঙ্গা নদী অর্থনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই নদী দিয়ে লঞ্চ এবং দেশী নৌকা চলাচল করতে পারে। অতীতে এই নদী ছিলো ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র। এই বুড়িগঙ্গা নদীর জন্যই ৪০০ বছর আগে এর তীরে গড়ে উঠেছিল ঢাকা শহর।
বুড়িগঙ্গা নদীর নামকরণ সম্পর্কে জনমুখে এক পৌরাণিক কাহিনী (মিথ) শোনা যায়। তা হলো–
“বহুকাল আগের কথা, তখন সাপ ব্যাঙে দোস্তি ছিলো। বাঘে-হরিণে এক ঘাটে পানি খেত। চিল মুরগির বাচ্চা বুকে নিয়ে পুষত। সে সময় ছিলো এক মস্ত ঋষি। ঋষির ছিলো মহা শক্তিশালী ছেলে। ছেলের নাম ছিলো পরশুরাম। পরশুরামের অস্ত্র ছিলো মণপাচেঁক ওজনের এক বিরাট কুঠার। তখন ব্রক্ষপুত্র হিমালয়ের এক গোপন কোনে চুপচাপ বসে ছিলো। পরশুরাম তার সেই বিশাল কুঠারাঘাতে পাথর কেটে ব্রক্ষপুত্রকে হিমালয়ের বুক থেকে বের করে নিয়ে এলো। ব্রক্ষপুত্র ভৈরব গর্জনে সমুদ্রের পানে ছুটে চলল। এমন সময় তার কানে গেলো শীতলক্ষ্যার অপরুপ রুপের কথা। আমাবস্যা-পূর্ণিমায় শীতলক্ষ্যা জোয়ারের খেলায় মাতে, শরতের শান্ত জ্যোৎস্নায় সে ছলছল কলকল করে। ব্রক্ষপুত্র দরুম দুরুম পার ভাঙতে ভাঙতে বিশাল গর্জনে শীতালক্ষ্যার দিকে এগিয়ে এলো। খবর শুনে শীতালক্ষ্যার ভয়ে ভয়ে বুক দুরুদুরু। এ দুর্দান্ত বরকে বরণ করতে সে তার মনকে রাজি করতে পারে না। সে তখন মন্ত্র পরে বুড়ি সেজে বসে রইলো। ব্রক্ষপুত্র তখন এসে হাঁক ছাড়ল, ‘কোথায় শীতলক্ষ্যা? ’সুন্দরী শীতলক্ষ্যা্ বলল, ‘আমাকেই লোক শীতলক্ষ্যা বলতো, আমি বুড়ি হয়ে বুড়িগঙ্গা হয়েছি’। ব্রক্ষপুত্র বলল, ‘চালাকি চলবে না, বিয়ে আমি তোমাকেই করবই।’ তখন ব্রক্ষপুত্র ও শীতালক্ষ্যার মিলন হলো। কিন্তু লোকে শীতালক্ষ্যার খানিক অংশ কে বুড়িগঙ্গাই বলতে লাগলো।’”
বাঙালির ইতিহাস গ্রন্থে সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন–
‘এখন গঙ্গা বলতে আমরা যা বুঝি, প্রায় পাঁচশো বছর আগে কৃত্তিবাসের আমলে গঙ্গার সেই দক্ষিণবাহী প্রবাহ কে বলা হতো ছোট গঙ্গা আর পূর্ব-দক্ষিণবাহী প্রবাহ কে বলা হতো বড় গঙ্গা-যাকে আমরা পদ্মা বলি’ পদ্মার একটি প্রচীনতম পথ রাজশাহী রামপুর বোয়ালীয়া হয়ে চলনবিলের ভেতর দিয়ে ধলেশ্বরী খাত দিয়ে ঢাকাকে পাশে রেখে মেঘনা খাড়িতে গিয়ে সমুদ্রে মিশত। তাই ঢাকার পাশের এ নদীটির নাম বুড়িগঙ্গা’।
নদীর গতিপ্রকৃতি
সাভার থানার ৬.৫ কিমি দক্ষিণে ফুলবাড়িয়ার কাছে ধলেশ্বরী থেকে বের হয়ে ঢাকার শহরের দক্ষিণ এবং পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নারায়নগঞ্জের চার কিমি পশ্চিমে ভূইরা নামক স্থানে ধলেশ্বরীতে পতিত হয়েছে জোয়ার-ভাটার নদী বুড়িগঙ্গা। ঢাকা শহরের কামরাঙ্গীচরের কাছে তুরাগ নদ বুড়িগঙ্গার সাথে মিলিত হয়। মূলত বুড়িগঙ্গার জলপ্রবাহ প্রধান অংশটাই আসে তুরাগ থেকে। প্রথমত এই নদী কিঞ্চিৎ দক্ষিণ-পূর্বমূখী হয়ে কিছদুর অগ্রসর হয়েছে। অতঃপর বনগ্রাম-মান্দাইল স্থানদ্বয় থেকে সোজা পূর্বদিকে সলিমুল্লা মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে। অতঃপর বুড়িগঙ্গা সেতু পেরিয়ে আবার দক্ষিণ-পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে ভবানীগঞ্জ হয়ে মুন্সিগঞ্জের ভুইরা নামক স্থানে আবার ধলেশ্বরীর সাথে মিলিত হয়েছে। ছাগলকান্দিরি কাছে বুড়িগঙ্গার উজান অঞ্চল পলি জমে ভরাট হয়ে পরেছে। তবে ভাটি অঞ্চল সারাবছরই নাব্য থাকে।
১৯৮৪ সালে এর পানিপ্রবাহের পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ ২ হাজার ৯০২ কিউসেক। তবে বর্তমানে বুড়িগঙ্গার পানিপ্রবাহের পরিমাণ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।
ইতিহাস
বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্য বাড়ানোর কাজ করেছিলেন বাংলার সুবাদার মুকাররম খাঁ। তার শাসনামলে শহরের যেসকল অংশ নদীর তীরে অবস্থিত ছিল, সেখানে প্রতি রাতে আলোক সজ্জা করা হতো। এছাড়া নদীর বুকে অসংখ্য নৌকাতে জ্বলতো ফানুস বাতি। তখন বুড়িগঙ্গার তীরে অপরুপ সৌন্দর্য্যের সৃষ্টি হতো।
১৮০০ সালে টেইলর বুড়িগঙ্গা নদী দেখে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন- বর্ষাকালে যখন বুড়িগঙ্গা পানিতে ভরপুর থাকে তখন দুর থেকে ঢাকাকে দেখায় ভেনিসের মতো।
সমস্যাসমূহ
কালের বিবর্তনে দখল হয়ে যাচ্ছে বুড়িগঙ্গার নদী তীর। ঢাকা শহরের কল-কারখানার বর্জ্য ও দূষিত পানি নির্গমনের ফলে ভয়ানকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। বুড়িগঙ্গার পরিবেশ বিপর্যয় ঢাকা শহরকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে ফেলেছে।
তথ্যসূত্র
১. মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক, বাংলাদেশের নদনদী: বর্তমান গতিপ্রকৃতি, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৫, পৃষ্ঠা ১৭-১৮, আইএসবিএন 984-70120-0436-4
২. ড. অশোক বিশ্বাস, বাংলাদেশের নদীকোষ, বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ (দ্বিতীয় প্রকাশন), পৃষ্টা ৩৩৬-৩৩৭-৩৩৮, ISBN-978-984-91643-5-7
৩. মোকাররম হোসেন, বাংলাদেশের নদী, কথাপ্রকাশ, আগস্ট ২০১৪ (দ্বিতীয় সংস্করণ), পৃষ্ঠা ১৩৮ ও ১৩৯
ফটোগ্রাফার: nachoipd [https://pixabay.com/users/nachoipd-488271]